এক নয়, দুই নয়, তিন, চার কিংবা পাঁচও নয়, টানা বিশ-বিশটা বছর। নির্দিষ্ট করে বললে বিশ বছরেরও কিছু বেশি। অন্য কেউ হলে নির্ঘাত বহু আগেই তার মাথা ঘুরেটুরে এলাহী কোনো কারবার হতো, আমাদের দেশে যা হয়; কিন্তু শচীন টেন্ডুলকার ভিন্ন, তিনি যেন ধরিত্রীর মধ্যে বাস করেও অন্য কোনো গ্রহ থেকে আগত, যিনি ব্যাট হাতে রানের বন্যা বইয়ে দিয়ে পরমুহূর্তেই বিনয়ের অবতার বনে যান। একজন মানুষের পক্ষে জীবনে যত ধরনের চরিত্রে অবতীর্ণ হয়ে সফল ভূমিকা পালন করতে পারা সম্ভব, তার সবটুকুই সুনিপুণভাবে বাস্তবে করে দেখান। অর্থাৎ জীবনের ইনিংসে যিনি একবারে সেঞ্চুরি... নানা ডাবল সেঞ্চুরি করে ফেলতে পারেন।
না আজকে, ক্রিজের শচীন বা ব্যাট হাতে একের পর এক রেকর্ড গড়া শচীনকে নিয়ে কিছু বলব না। কিছুতেই বলব না। কারণ গত দুই দশক ধরে যার ব্যাট একই তাল-লয় ও সুর মেনে কথা বলে, তার ক্রিকেটীয় ক্ষমতা নিয়ে কিছু বলা আমার অতি ক্ষুদ্র জ্ঞানবিশিষ্ট কারও জন্য রীতিমতো ধৃষ্টতার শামিল। তাই সে প্রসঙ্গে সযত্নে ও স্বেচ্ছায় পাশ কাটিয়ে বরং অন্য একটা বিষয় নিয়ে কিছু বলি, যেখানেও শচীন অদ্বিতীয়, সবার অনুকরণীয় ও অনুসরণীয়। অসামান্যও বটে। তিনি ব্যক্তি শচীন, অঞ্জলির স্বামী শচীন, আনন্দ মেহেতার জামাতা শচীন, মেয়ে সারা ও ছেলে অর্জুনের বাবা শচীন, রমেশ ও রজনী টেন্ডুলকারের চার সন্তানের ছোট ছেলে শচীন এবং একশ' বিশ কোটি মানুষের আশা-ভরসার প্রতীক শচীন এবং সর্বোপরি যিনি ক্রিকেটের অ-আ-ক-খ কিছু বোঝেন না তার কাছেও আদর্শের প্রতীক, সাফল্যের শেষ কথা হওয়া, হয়ে যাওয়া শচীন।
তবে এ পরিচয়গুলোর প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি কিন্তু আমি বা আপনার চেয়ে আলাদা কেউ নন। জন্মসূত্রে কিংবা বৈবাহিক সূত্রে আমরা প্রত্যেকেই এ পরিচয়গুলো পেয়ে যাচ্ছি। বিনা পরিশ্রমে পাওয়া জিনিসের কেউ মূল্য দেয় না, আমরাও তো রক্ত-মাংসের মানুষ; সুতরাং এর থেকে ভিন্ন আচরণ আমরা করব কেন? ফলে আমরাও সচেতনভাবে দায়িত্ব এড়াতে কুণ্ঠাবোধ করি না ও আমাদের একেকটা সত্তার ওপর অর্পিত কর্তব্য বেমালুম ভুলে বসে থাকি। তাই বলে শচীন তো আর এমন করতে পারেন না।
এক দেশপ্রেমের কথাই যদি বলি, তাহলেও তিনি আমাদের চেয়ে যোজন যোজন ব্যবধানে এগিয়ে। তেরঙ্গা আঁকা হেলমেট ক্রিকেটাররা মাঠে ও ড্রেসিংরুমের যেখানে সেখানে ফেলে রাখেন বলে জাতীয় পতাকার অবমাননা হয়- এ যুক্তিতে যখন ভারত সরকার ক্রিকেটারদের হেলমেটে পতাকার ব্যবহার নিষিদ্ধ করল, তখনও সবার আগে যিনি প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন তিনি শচীন, তার ক্রমাগত দাবির অনুরোধের কারণে শুধু শচীনের হেলমেটেই পতাকা ব্যবহারের অনুমতি দেয় সে দেশের ক্রিকেট বোর্ড।
এ ধরনের উদাহরণ আরও আছে। সময়কাল ১৯৯৯, ইংল্যান্ডে বিশ্বকাপ চলছে, জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে খেলার দিন খবর এলো বেশ কিছুদিন ধরে অসুস্থ থাকা শচীনের বাবা রমেশ টেন্ডুলকার আর নেই, পাড়ি জমিয়েছেন আর না ফেরার দেশে। ওই মুহূর্তে বাবাকে চিরকাল আদর্শ মানা ছেলের কী রকম মানসিক অবস্থা হয় সেটি অনুধাবন করা যায় সহজেই, কিন্তু সদ্য বিধবা হওয়া মায়ের পাশে দাঁড়ানোর জন্য ঠিকই ইংল্যান্ড থেকে মুম্বাই উড়ে এসে শেষকৃত্যে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। সবাই যখন তাকে পুরো বিশ্বকাপেই দেখতে না পারার আশঙ্কায় ভুগছে তখন আবার দু'দিনের মধ্যেই মহারাষ্ট্র থেকে লেইস্টারে ফিরেই অপরাজিত ১৪০ রানের আলো ঝলমলে ইনিংস খেলতে পারেন একমাত্র টেন্ডুলকারই। সেঞ্চুরি পেরোনোর পর সেটি প্রয়াত বাবাকে উৎসর্গ করে এও জানিয়ে দেন, বাবার দেখা প্রতিটা স্বপ্ন বাস্তবায়নে তিনি কতটা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। একই সঙ্গে সবাইকে শিখিয়ে দেন, জীবনের কঠিনতম সময়ে কী করে নিজের আবেগকে সংবরণ করতে হয়, দেশের প্রতি কর্তব্য কীভাবে সর্বদা সর্বাগ্রে স্থান দিতে হয়।
এ প্রসঙ্গেই চলে আসে ব্যক্তি শচীনের কথা। তার স্ত্রী অঞ্জলি একবার বলেছিলেন, 'ওর মধ্যে কোনো ধরনের বাগাড়ম্বর ভাব নেই, একেবারেই মাটির মানুষ শচীন।' শচীনের এ দিকটাই নাকি অঞ্জলিকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করে। কখনোই শচীন নিজেকে খুব বড় কিছু ভাবতে পছন্দ করেন না। নিজ অবস্থান থেকে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে এটিই যেন তার সাফল্যের মূলমন্ত্র। এজন্য যতটা পরিশ্রম করা প্রয়োজন তার চেয়ে হাজার গুণ বেশি পরিশ্রমই করেন তিনি। তাছাড়া তিনি কখনোই চাননি তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে পত্রপত্রিকায় খুব বেশি লেখালেখি হোক, তার ছেলেমেয়েরা সবসময় পাদপ্রদীপের আলোয় বেড়ে উঠুক। খ্যাতির প্রাচুর্য ও খাতিরের আধিক্যে তারা গা ভাসিয়ে দিক। বাবা হিসেবে শচীন কতটুকু সফল সেটি সময়ই বলে দেবে কিন্তু তার তেরো বছর বয়সী মেয়ে সারা যখন দরিদ্র তহবিল সংগ্রহের জন্য ম্যারাথন প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়, তখনই বোঝা যায়, এ কাজটাতেও তিনি অসম্ভব পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। অন্তত সারা ও অর্জুনকে যোগ্য মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব নিতেও তিনি পিছপা হননি। কারণ পিতা সবাই হতে পারে কিন্তু সঠিকভাবে পিতৃত্বের মর্যাদা রক্ষা করতে পারে ক'জন? তবে আর যা-ই হোক, শচীন অন্তত এই না পারার গোত্রে পড়েন না।
অথচ ঘটতে পারত একেবারে উল্টো ঘটনা। এত অল্প বয়সে এত খ্যাতি, এত প্রাচুর্য যে পায় তার মাথা ঠিক থাকে না, থাকার কথা নয়, সাফল্যের সঙ্গে মাটির একটা ব্যস্তানুপাতিক সম্পর্ক আছে বিধায় সাফল্য যত বেশি হয়, মানুষের সঙ্গে মাটির ব্যবধান ততটাই বেড়ে যায়। কিন্তু ওই যে বললাম, অন্য অনেক ব্যাপারের মতো এখানেও শচীন ভিন্ন, শুধু ভিন্ন বললে যাকে ভুল বলে অভিহিত করা হয়, তিনি মূর্তিমান ব্যতিক্রম। গলফে টাইগার উডস, ফুটবলে জন টেরি, ক্রিকেটে শেন ওয়ার্নের রোমান্স নিয়ে কত রকম গালগল্প প্রকাশিত হয়েছে ও হচ্ছে দিনের পর দিন, কিন্তু শচীন সেসব থেকে শতহস্ত দূরে, তাকে ঘিরে কোনো স্ক্যান্ডাল নেই, ম্যাচ পাতানোর মতো বিষবাষ্প তাকে ঘিরে ধূমায়িত হতে দেখা যায়নি। তার জীবনের গল্প একেবারেই পরিবারকেন্দ্রিক, সবার কাছে যিনি আদ্যপান্ত একজন 'ফ্যামিলি ম্যান', ঘরে ফিরে যিনি নিজ ভুবন নিয়েই থাকতে ভালোবাসেন, সাত-পাঁচ না ভেবে কোনো প্রকার উন্মাদনায় যোগ দেন না।
আসলে আমরা, যারা সাধারণ, যারা স্রোতের তোড়ে গা ভাসিয়ে ভুলে যেতে পারি, কর্মক্ষেত্রে যে যত বড়ই হয়ে যাই না কেন, জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল মানুষ, কর্তব্যপরায়ণ ব্যক্তি হিসেবে আচরণ না করলে শেষ পর্যন্ত সেটির মূল্য দিতে হয় চরম, কিন্তু তিনি কিছুতেই ভোলেন না। আর তিনি ভুলে যাননি বলেই তিনি এখন দেবতার আসনে আসীন, এককালে বেবি ফ্যাটের চিহ্ন মুখে নিয়ে ক্রিকেট বিশ্বে পা রাখা 'বিস্ময় বালক' আজ পরিণত বয়সে এসে 'বালকে'র তকমা ঝেড়ে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার কাছে রীতিমতো একজন বিস্ময়কর মানুষ। আরও স্পষ্ট করে বললে যোগ্য ও দায়িত্বশীল মানুষ! অনন্য সাধারণ মানুষ!
No comments:
Post a Comment