14 July 2011

এ জাতি বাবা’র সাথে ধোঁকাবাজি করেছে


বাবাকে ছাড়া আমার সারাদিন কাটবে এটা এখন ভাবতেই কষ্ট হয়, আব্বু আমাকে ছাড়া কিছু বুঝতো না, আমিও তাকে ছাড়া কিছু বুঝতাম না। সবসময় সবকিছু শেয়ার করতাম। সবকিছু আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতাম। তিনিও সব দুঃখ কষ্ট শেয়ার করতো আমিও করতাম। হয়তো সব মেয়েরই একই অনুভূতি। কিন্তু যার যায় সে-ই বোঝে। যে কোন সিদ্ধান্তে আব্বুকেই প্রথম ভাবতাম। আমি এত বাবা পাগল মেয়ে ছিলাম, যে সবাই আমাকে দুষ্টুমি করে রাগানোর চেষ্টা করতো।

আজ কোন ডিসিসান নেওয়ার সময়ই আব্বুকে খুব বেশী মিস করি। আব্বুর পার্সোনালিটিটা আমার কাছে খুব স্পেশাল। উনি আমার আদর্শ। দেখা গেছে যে, আব্বু থাকাবস্থায় আমাদের যেই প্রাধান্যটা ছিলো সব জায়গায়, এখন খুব আপন মানুষই খুব অপরিচিত হয়েছে। আমরা যার যার যেরকমই ছিলাম সেরকমই আছি। মিডিয়ার অনেক মানুষের কাছেই। কিন্তু আব্বু চলে যাবার পর তাদের যে এই দুরত্ব তা খুবই অবাক করে। আজ বাবার মৃত্যুবার্ষিকী নিয়ে এতসব চ্যানেল, সাংবাদিকদের থেকে ডাক পড়ছে। সবই যেন স্বার্থের এক চরম ব্যবহার। আমাদের মানসিকতার এই চরম স্খলন সত্যিই খুব কষ্ট দেয়। হয়তো এটাই বাস্তবতা! যা মেনে নেয়া খুবই কঠিন। মাঝখানে একটা বছর সবাই খুব চুপচাপ। খুব ঘনিষ্ঠ জনরাই ওনার অবর্তমানে অপরিচিত হয়ে গেছে। আমার দুই সন্তানদের নিয়ে আব্বুর অবসর সময়টা খুব কাটতো। একই বিল্ডিংয়ের দুই ফ্লোরে আমরা থাকতাম। আমার ছেলেদের পাঠিয়ে দিতাম। খেলা করতো ওরা ওদের নানুর সাথে। বাহিরে যাওয়ার সময় আব্বুর সাথে দেখা করে যেতাম, আসার সময় দেখা করতাম। আমার আর বাপের বাড়ী বলে কিছু থাকলো না। ওখানে গেলেই খুব খারাপ লাগে। বড় ছবিটা দেখি মাঝে মাঝে, মনে হয় আব্বুর বুকে ব্যথা দিয়েছি, রান্নার ব্যাপারে কিছু হলে, খুশি হলে মাথায় হাত দিতো। এখন মাথায় হাত দেওয়ার মতোও কেউ নেই। রাঁধতেও ভাল লাগেনা। আমার বাচ্চারাও নানাকে অনেক মিস করছে, নানার আদর থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আব্বুর ইচ্ছে ছিলো আমি কিছু করি। ভাবছিলাম বাচ্চারা বড় হয়ে গেলে কিছু করবো। কিন্তু এখন জানিনা আসলে কি পারবো বা কতটুকু পারবো।

আব্বুকে নিয়ে একটা ডকুমেন্টারী করেছিলাম। আমি যেই ভার্সিটিতে পড়েছি, সেখানকার অনেক শিক্ষক আব্বুর সহকর্মী, তারা আব্বুকে নিয়ে ক্লাসে অনেক প্রশংসা করতো, এগুলো বাসায় এসে আব্বুর সাথে শেয়ার করতাম। এখন এগুলোও পারি না।

ঐসময়গুলো খুবই গর্বের। আব্বু খুব অসুস্থ ছিলো শুনতো, একটা মিস্টি করে হাসি দিতো, সেই হাসিটাই আমার সামনে আছে।

বুলবুল আহমেদ এর মেয়ে আসছে, মেয়ে আসছে, একটা বিশেষত্ব থাকতো আগে। তা যেন হঠাত্ করেই মিইয়ে গেল। এ কেমনতর আচরণ। এই কঠিন বাস্তবতা মেনে নেয়া বড় কঠিন। তবে কি সবার আচরণই এক কঠিন অভিনয়। একটা বড় ধোঁকা!

এক বছর কেটে গেলো, ভাবাই যায় না আব্বুকে ছাড়া। কথা বলিনি আব্বুর সাথে একটা বছর। আব্বুর জিনিস নিয়ে ইদানিং ঘাটাঘাটি করছি, একটু পরপরই কেঁদে উঠি। দোয়া করি আব্বু যেনো ভালো থাকে, আমাদেরকে যেভাবে সুশিক্ষা দিয়েছে আমরা যেনো আমাদের সন্তানকে সুশিক্ষা দিয়ে মানুষ করতে পারি। আব্বু এতো সম্মানিত ছিলেন, ওনার জন্য আমরা কখনও লজ্জিত হইনি, বরং সম্মান পেয়েছি। নামাজ পড়ি, তখনও মনে পড়ে, আব্বু আমাকে শিখিয়েছে। নিজেকে গর্বিত বোধ করি বুলবুল আহমেদ এর মেয়ে হিসেবে। আব্বুর কারণেই সবসময় সবকিছু সহজ হয় আমাদের। কিন্তু আজ চারদিকে শূন্যতা, শুধুই শূন্যতা।

সবচেয়ে বড় কথা এই দেশ ও জাতি বাবার সাথে যে ধোঁকাবাজি করেছে তা লজ্জা দেয় সবাইকে। আমরা গুণী মানুষদের জীবদ্দশায় সম্মান জানাতে শিখিনি। বাবা জীবিত থাকা অবস্থায় তাকে একুশে পদক দেবার কথা থাকলেও দেয়া হয়নি, মৃত্যুর পর মরোণত্তর দেবার কথা ছিল, সেও আজ এক বছর পার হয়ে গেল। তবে বাবা কোন জাতির জন্য এতকিছু করলো! এ সব ভাবতে গেলে লজ্জায় মাথা নত হয়ে আসে। আমি আমার ছেলে-মেয়েদেরও হয়তো আগামী এইসব কঠিন প্রশ্নের কোন উত্তর দিতে পারবো না। আজ তাই এইসব স্মৃতিচারনও লিখতে ইচ্ছে করে না। আমাদের মানবিক শক্তি,অনুভূতিগুলো যেন ক্রমেই ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে। ভেতরের আমার আমি’টা আর কারো’র ভেতরেই খুঁজে পাওয়া যায় না। সবাই যেন লেবাসধারী। লোক দেখানো হাসি হাসে, লোক দেখানো কান্না। তাই আমার এই স্মৃতিনোট বাবার উদ্দেশ্যেই। আব্বু তোমার ভেতরের যেই সরলতা দিয়ে মানুষদের মুগ্ধতা দিয়ে গেছ, তারা কেউ ই সেই সারল্য ধারণ করার যোগ্য নয়। অনেক কষ্ট, আক্ষেপ নিয়েই এ কথা গুলো লিখছে তোমার মেয়ে। ভাল থেকো বাবা। ভাল থেকো।

লেখক: ঐন্দ্রিলা আহমেদ

No comments:

Post a Comment