15 September 2011

ঐতিহ্যের টানে দুই যমজ বোন


প্রখ্যাত সরোদশিল্পী ওস্তাদ শাহাদত হোসেন খানের দুই যমজ মেয়ে আফসানা খান ও রুখসানা খান। আফসানা খান বাজান সেতার আর রুখসানা খান সরোদ। আফসানা খান রজনীগন্ধার পুষ্পদণ্ডের মতো ছিপছিপে লম্বা। তাঁর ডাগর চোখ দুটি নিবিড় কালো, হাসি শব্দহীন স্মিত, গায়ের রং উজ্জ্বল, শান্ত-স্নিগ্ধ ভাব। সব মিলিয়ে এক অপূর্ব ব্যক্তিত্বের ছাপ।

অন্যদিকে রুখসানা খান যেন আফসানা খানের ঠিক উল্টো। প্রাণ খুলে হাসতে জানেন। উচ্ছ্বল, প্রাণবন্ত, মিশুক। কিছু বিষয়ে দুই বোনের মধ্যে কখনো কখনো মতভেদ দেখা দেয়। এ ছাড়া দুই বোনের মধ্যে অমিল প্রায় নেই বললেই চলে। দুই বোন একসঙ্গে ব্রিটিশ-আমেরিকান কনসাল্টে এলএলবি পড়ছেন। দুজনেরই একই রকম পোশাক ও সাজসজ্জা পছন্দ। তাঁদের বন্ধুবান্ধবের তালিকাও প্রায় একই। আড্ডা, কৌতুক, ঠাট্টা, খুনসুটি ও আনন্দ-উল্লাসে গলাগলি করে দিন কাটে তাঁদের। ১৯৮৯ সালে উপমহাদেশের প্রখ্যাত সংগীত সাধক ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ এবং ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁর বংশে তাঁদের জন্ম। দাদা ছিলেন প্রখ্যাত সেতার ও সরোদশিল্পী ওস্তাদ আবেদ হোসেন খান।

সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের মধ্যে বেড়ে ওঠা দুই বোন স্বাভাবিকভাবেই যন্ত্রসংগীতে আকৃষ্ট হয়েছেন শৈশবে। বাবা ওস্তাদ শাহাদত হোসেন খান বলেন, 'শৈশবে আফসানা ও রুখসানা বসে বসে আমাদের সেতার-সরোদ বাজানো শুনত। পরে দুই বোন হাতের কাছে লাঠি-খেলনা যা পেত, তা নিয়ে বাজানোর চেষ্টা করত। একবার আফসানা ভারী একটা কাঠ নিয়ে বাজাতে গিয়ে আহত হয়। আফসানা আকৃষ্ট হয় সেতারের প্রতি। আর রুখসানার আগ্রহ জন্মে সরোদে।'

মেয়েদের আগ্রহের কথা বিবেচনা করে ওস্তাদ শাহাদত হোসেন খান তাঁদের হাতে তুলে দেন সেতার-সরোদ। ছয় বছর বয়সে দুই বোন বাবার কাছে সেতার-সরোদে তালিম নেওয়া শুরু করেন। মাত্র সাত বছর বয়সে দাদার মৃত্যুবার্ষিকী স্মরণে জার্মান কালচারাল সেন্টারে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বাবার সঙ্গে সেতার-সরোদ বাজিয়ে উপস্থিত দর্শকদের মুগ্ধ করেন। ২০০৪ সালে মহিলা সমিতিতে চৈত্রসংক্রান্তি, ইন্টারন্যাশনাল মিউজিক ফেস্টিভ্যাল এবং ময়মনসিংহ জিলা স্কুলের ১৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বাবার সঙ্গে ত্রয়ী সেতার-সরোদ বাজিয়ে খ্যাতি অর্জন করেন। প্রতিবছর ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, আয়েত আলী খাঁ ও আবেদ হোসেন খাঁ স্মরণে অনুষ্ঠানে সেতার-সরোদ বাজিয়ে দর্শকদের মুগ্ধ করেন তাঁরা। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সেতার-সরোদ বাজিয়ে পিছিয়ে পড়া অবহেলিত যন্ত্রসংগীতের প্রসার ও জনপ্রিয়তা সৃষ্টির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ১৯৯৭ সালে বেতার এবং ২০০৪ সালে বিটিভির তালিকাভুক্ত হন দুই বোন। গত ২৮ মার্চ সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ইউএনও-বাংলাদেশ দূতাবাসের যৌথ আয়োজনে বাবার সঙ্গে ত্রয়ী সেতার-সরোদ বাজিয়েছেন তাঁরা। কিছুদিনের মধ্যেই ইংল্যান্ডের একটি যন্ত্রসংগীত অনুষ্ঠানে সেতার-সরোদ বাজানোর কথা রয়েছে।

যমজদের সম্পর্কে একটা কথা প্রচলিত আছে, একজনের অসুখ হলে অন্যজনেরও অসুখ হয়। রুখসানা খান বলেন, 'আমাদের ক্ষেত্রে এমন ঘটে না। তবে কাকতালীয় ব্যাপার হলো, পরীক্ষায় আমার যে ভুল হতো, একই ভুল আফসানারও হতো।' দুই বোনের মধ্যে দারুণ সখ্য। মাঝেমধ্যে একটু-আধটু মান-অভিমান হলেও দুজন দুজনকে খুবই ভালোবাসেন। দুদণ্ড একজন আরেকজনকে না দেখলে অস্থির হয়ে যান। রাত ১১টা পর্যন্ত চলে দুই বোনের এলএলবির পড়াশোনা। তারপর বসে পড়েন বাবার সঙ্গে রেওয়াজ করতে। দুই বোনের এগিয়ে যাওয়ার পেছনে রয়েছে মা রেবেকা খান ও বাবার প্রেরণা। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো, দুই বোনের কেউই সেতার-সরোদ বাদনকে পেশা হিসেবে নিতে চান না। পেশায় তাঁরা হতে চান আইনজীবী। কারণ হিসেবে বললেন, 'নানা কারণে যন্ত্রসংগীত আমাদের দেশে অবহেলিত। পেশা হিসেবে নেওয়ার মতো অবস্থা তৈরি হয়নি। উপমহাদেশীয় শাস্ত্রীয় যন্ত্রসংগীতের অন্যতম ধারক ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ এবং আয়েত আলী খাঁর বংশ। আমরা আমাদের বংশের ঐতিহ্য ধরে রাখতে চাই।'

No comments:

Post a Comment